জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট দুর্যোগ (পাঠ ৩)

সপ্তম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বাংলাদেশের জলবায়ু | - | NCTB BOOK
270
270

বাংলাদেশে প্রায়ই নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটে। এসব দুর্যোগের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, নদীভাঙন, খরা, শৈত্যপ্রবাহ, টর্নেডো, কালবৈশাখী, বজ্রপাত প্রভৃতি। এছাড়াও বাংলাদেশ ভূমিকম্পের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।

common.content_added_by

ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস (৩.১)

261
261

কোনো স্থানে বাতাসে তাপ অত্যধিক বৃদ্ধি পেলে সেখানকার বাতাস হালকা হয়ে উপরে উঠে যায়। ফলে ওই অঞ্চলের বাতাসের চাপ কমে যায়। ফলে নিম্নচাপ সৃষ্টি হয়। এ সময় আশেপাশের অঞ্চল থেকে বাতাস প্রবল বেগে ওই নিম্নচাপ অঞ্চলের দিকে ছুটে আসে। নিম্নচাপ অঞ্চলের দিকে বায়ুর এই প্রবল গতিকে বলে সাইক্লোন বা ঘূর্ণিঝড়। বাংলাদেশে অধিকাংশ ঘূর্ণিঝড় হয় বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপের কারণে। সমুদ্রে সৃষ্ট নিম্নচাপ ও ঝড়ের ফলে সমুদ্রের লোনা জল বিশাল উচ্চতা নিয়ে তীব্রবেগে উপকূলে আছড়ে পড়ে এবং স্থলভাগকে প্লাবিত করে। একেই বলে জলোচ্ছ্বাস। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে এ পর্যন্ত কয়েকবার ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস মারাত্মকভাবে আঘাত হেনেছে।

এতে অসংখ্য মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। গবাদিপশু ও ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ১৯৭০ সালের ১২ই নভেম্বর বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে ঘটে যাওয়া এমনি একটি ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে প্রায় দশ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়। সাম্প্রতিককালে ঘটে যাওয়া এ রকম দুটি বড়ো ঘূর্ণিঝড় হলো সিডর ও আইলা। ২০০৭ সালের ১৫ই নভেম্বর সিডর-এ দেশের ২৮টি জেলার প্রায় ৩০ লক্ষ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। আর ২০০৯ সালের ২৫শে মে আইলায়ও মানুষ, পশুপাখি, ফসল ও ঘরবাড়ির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। ঘূর্ণিঝড়ের আগে সাধারণত আবহাওয়া বিভাগ থেকে এ সংক্রান্ত পূর্বাভাস ও সতর্কবাণী প্রচার করা হয়। আমরা যদি সে সতর্কবাণী মেনে আগে থেকে সাবধান হই, তবে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের সময় প্রাণহানি এড়ানো যায়। এ সময় দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিয়ে ঘূর্ণিঝড়-আশ্রয়কেন্দ্র ও নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিতে হবে।

common.content_added_by

বন্যা (৩.২)

168
168

বাংলাদেশে প্রতি বছরই কমবেশি বন্যা হয়। বাংলাদেশের প্রধান তিনটি নদী পদ্মা, যমুনা ও মেঘনাসহ প্রায় সবগুলো নদীরই উৎস ভারতে। এসব নদনদী হিমালয়ের বরফগলা ও উজানে বৃষ্টিপাতের ফলে সৃষ্ট বিপুল পানিপ্রবাহ বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে বয়ে নিয়ে বঙ্গোপসাগরে ফেলে। বৃষ্টির পানি ও পাহাড় থেকে নেমে আসা পানি একসঙ্গে মিলে নদীগুলোর পানি বৃদ্ধি করে পাড়ে উপচে দু-কূলের জনপদকে প্লাবিত করে ও জানমালের ক্ষতি করে।

এছাড়া উজানের দেশগুলোতে অপরিকল্পিত বাঁধ ও নদীসংযোগ প্রকল্পের কারণেও বন্যার সৃষ্টি হয়। অন্যদিকে বর্ষা মৌসুমে নদীগুলো লক্ষ লক্ষ টন পলি বয়ে আনে, যার সবটা সাগরে যায় না, কিছু অংশ নদীর তলদেশে জমা হয়ে তাকে ভরাট করে ফেলে। এতে নদীর জলধারণ ক্ষমতা কমে যায়। পানি উপচে আশেপাশের এলাকা প্লাবিত হয়। প্রায় প্রতি বছর বন্যায় আমাদের দেশে মানুষ ও সম্পদের অনেক ক্ষতি হয়। ব্যাপক ফসলহানি ঘটে, ফলে খাদ্যাভাব দেখা দেয়। অনেক মানুষ কাজ হারিয়ে বেকার হয়ে পড়ে। ১৯৮৮, ১৯৯৮ ও ২০০৪ সালে এদেশে বড়ো আকারের বন্যা হয়েছে। বর্তমানে বিশেষজ্ঞরা বলেন, বন্যা একেবারে প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। তবে বন্যার ক্ষয়ক্ষতি কমানো সম্ভব।

common.content_added_by

নদীভাঙন (৩.৩)

192
192

নদীভাঙন বাংলাদেশের একটি নিয়মিত দুর্যোগ। প্রতিবছর বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে নদীভাঙন দেখা দেয়। নদীভাঙনের একটি কারণ হলো বাংলাদেশের নদীগুলোর গতিপথের ধরন। আমাদের অনেক নদীরই গতিপথ আঁকাবাঁকা। নদীর বাঁকগুলোও ঘনঘন। ফলে পানির প্রবল স্রোত সোজাপথে প্রবাহিত হতে না পেরে নদীর পাড়ে এসে আঘাত করে।

এজন্য নদীর পাড় ভাঙতে থাকে। এছাড়াও নদীর গতিপথ পরিবর্তন, নদীপাড়ের মাটির দুর্বল গঠন, নদীভরাট ও যেখানে-সেখানে বাঁধ দিয়ে নদী শাসনের চেষ্টা, নতুন নতুন সেতু নির্মাণ, নদীর পাড়ে যথেষ্ট গাছপালা না থাকা ইত্যাদি কারণেও নদীভাঙন ঘটে। নদীভাঙনের ফলে এ দেশে হাজার হাজার একর আবাদি জমি, বসতবাড়ি ও অন্যান্য স্থাপনা বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে প্রতিবছর এ দেশের হাজার হাজার মানুষ ভিটেমাটি ও কাজের সংস্থান হারিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ছে। যেসব কারণে নদীভাঙন ঘটে থাকে সে-সম্পর্কে সচেতন হলে নদীভাঙন ও তার ক্ষয়ক্ষতি অনেকাংশে কমানো সম্ভব।

common.content_added_by

খরা (৩.৪)

153
153

খরা বাংলাদেশের একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ। প্রয়োজনীয় বৃষ্টিপাতের অভাবে ও ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে গেলে খরা হয়। প্রায় প্রতি বছর বসন্তের শেষ ও গ্রীষ্মের শুরুতে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে খরা দেখা যায়। উত্তরাঞ্চলে এই খরার প্রকোপ বেশি। পানির অভাবে জমির সেচকাজ ব্যাহত হয়, ফসল নষ্ট হয়। বৃষ্টিপাতের অভাব ছাড়াও বিভিন্ন নদীর উজানে বাঁধ নির্মাণ, বননিধন, পরিবেশদূষণ ইত্যাদি কারণেও খরা হয়। এই প্রাকৃতিক দুর্যোগটি পুরোপুরি প্রতিরোধ করা হয়ত সম্ভব নয়। তবে সচেতন হলে ও সময়মতো ব্যবস্থা নিলে খরাজনিত ক্ষয়ক্ষতি অনেক কমানো যেতে পারে।

ভূগর্ভস্থ পানির স্তর পরীক্ষা করে মাটির নিচ থেকে পানি উত্তোলন বন্ধ করতে হবে। বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে রাখতে হবে। সুষ্ঠু পানিব্যবস্থাপনা ও পানি ব্যবহারে গণসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।

common.content_added_by

শৈত্যপ্রবাহ (৩.৫)

122
122

বাংলাদেশ শীতপ্রধান দেশ না হলেও কোনো কোনো বছরে ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে হিমালয়ের উত্তর দিক থেকে আগত মৃদু থেকে মাঝারি শৈত্যপ্রবাহ দেখা যায়। বিশেষ করে দেশের উত্তরাঞ্চলে এর তীব্রতা বেশি হয়। প্রবল শীতে মানুষের প্রাণহানিও ঘটে। শৈত্যপ্রবাহের ফলে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ কাজ পায় না। শৈত্যপ্রবাহে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। বাসস্থান ও শীতবস্ত্রের অভাবে দরিদ্র জনগোষ্ঠীই বেশি দুর্দশায় পড়ে। সরকার ও সমাজের সচেতন মানুষের সহায়তা ও উদ্যোগে শৈত্যপ্রবাহে মানুষের কষ্ট অনেকটা কমানো সম্ভব।

common.content_added_by

টর্নেডো (৩.৬)

137
137

বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে টর্নেডো অন্যতম। এটি প্রচণ্ড গতিসম্পন্ন এক ধরনের ঘূর্ণিঝড়। স্থলভাগে নিম্নচাপের ফলে এর উৎপত্তি হয়। এটি স্থানীয়ভাবে সংঘটিত এক ধরনের ঝড়। টর্নেডো এমন একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ যার সম্পর্কে কোনো পূর্বাভাস বা সতর্কসংকেত দেওয়া যায় না। টর্নেডো শুরুর পূর্বে আকাশে ফানেল বা হাতির গুঁড়ের মতো মেঘ দানা বাঁধে। এই হাতির শুঁড়ের মতো মেঘ ক্রমে ভূপৃষ্ঠের নিম্নচাপ অঞ্চলের দিকে ধেয়ে আসে। এই মেঘটি যখন ঘুরতে ঘুরতে একস্থান থেকে অন্যস্থানে ছুটে চলে তখন সেখানকার বাড়িঘর, গাছপালা ভেঙ্গে যায় এবং মানুষ ও পশুপাখি মারা যায়। ফানেলের অভ্যন্তরে প্রচুর ঘূর্ণন চলতে থাকে। এই গুঁড়ের মতো টর্নেডো যখন মাটি স্পর্শ করে তখন সবকিছুকে তছনছ করে ফেলে। এমনকি এক স্থানের জিনিসপত্র অন্যস্থানে নিয়ে যায়। এটি কোনো স্থানে আচমকা আঘাত হেনে মুহূর্তের মধ্যে সবকিছু লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে যায়। এর স্থায়িত্বকাল হয় খুবই অল্প, কয়েক সেকেন্ড থেকে কয়েক মিনিট মাত্র। খুব কম জায়গায় এটি আঘাত হানে। বাংলাদেশে সাধারণত ফাল্গুনের শেষ থেকে জ্যৈষ্ঠ মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত সময়ে টর্নেডো হয়ে থাকে।

common.content_added_by

কালবৈশাখি (৩.৭)

141
141

কোনো স্থানের তাপমাত্রা প্রচুর বেড়ে গেলে সেখানকার বাতাস হালকা হয়ে উপরে উঠে যায়। তখন পাশের অঞ্চলের অপেক্ষাকৃত শীতল বাতাস প্রবল বেগে এই শূন্যস্থানে ধেয়ে আসে ও ঝড়ের সৃষ্টি করে যা আমাদের দেশে কালবৈশাখি ঝড় নামে পরিচিত। কালবৈশাখি হলো এক ধরনের ক্ষণস্থায়ী ও স্থানীয়ভাবে সৃষ্ট প্রচণ্ড ঝড়। সাধারণত বৈশাখ মাসেই এ ঝড় বেশি হয় বলে একে কালবৈশাখি বলা হয়। প্রায় সময় উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে এ ঝড়টা আসে।

বাংলাদেশে প্রতি বছরই কমবেশি কালবৈশাখি ঝড় হয়ে থাকে। টর্নেডোর মতো অত বিধ্বংসী না হলেও এ ঝড়েও জানমালের প্রচুর ক্ষতি হয়। কালবৈশাখি ঝড় ঘরবাড়ি উড়িয়ে নেয়, গাছপালা উপড়ে ফেলে, নৌ-চলাচলে বিঘ্ন ঘটায়। কালবৈশাখির কবলে পড়ে ভয়াবহ নৌ-দুর্ঘটনাও ঘটে। এজন্য কালবৈশাখির মৌসুমে নদীপথে নৌকা ও লঞ্চ চলাচলে বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করা প্রয়োজন।

কাজ-১: বাংলাদেশে কী কী প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটে তার একটি তালিকা তৈরি কর।
কাজ-২: বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের ধরন ও তার ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন তৈরি কর।
common.content_added_by
টপ রেটেড অ্যাপ

স্যাট অ্যাকাডেমী অ্যাপ

আমাদের অল-ইন-ওয়ান মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে সীমাহীন শেখার সুযোগ উপভোগ করুন।

ভিডিও
লাইভ ক্লাস
এক্সাম
ডাউনলোড করুন
Promotion